বছরের এই সময়টা এই গরম এই ঠান্ডা। আবহাওয়া শুষ্ক হওয়ার কারনে বাতাসে ধুলা-বালির পরিমাণ বেড়ে যায়। এই সময়ে বেশির ভাগ মানুষই ঠান্ডা-কাশি এবং জ্বরে আক্রান্ত হয়। এমনকি আপনি যদি খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকেন এবং অনেক ভিটামিন সি জাতীয় খাবার গ্রহন করেন, তবুও আপনার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। ঠাণ্ডা লাগার ফলে গলায় খুসখুসে অনুভূতি, কাশি, মাথা ধরে থাকা ও ভারী বোধ হওয়া, জ্বর ইত্যাদি খুব সাধারণ উপসর্গ।
এই অসুস্থতা এড়ানোর কোনও উপায় নেই, কিন্তু এর প্রতিকারের উপায় অবশ্যই আছে। চলুন, জেনে নেই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ২৭ টি উপায়, যা দিয়ে শীতকালীন ঠান্ডা-কাশি নিরাময় করা সম্ভব।
১। আদা চাঃ ঠান্ডায় গলা ও নাক যখন বন্ধ হয়ে তখন নাক ও গলা পরিষ্কার ও ব্যথা উপশম করতে আদা চা খুব কাজের। কিছু আদা কুচির সাথে অল্প পরিমান শুকনা মরিচ সিদ্ধ করে পানিটা খেয়ে নিতে পারেন। এতে আপনার গলা ও নাসারন্ধ্র পরিস্কার হয়ে যাবে। এবং বুকে আটকে থাকা কফ তরল হয়ে পড়ে যাবে।

২। আদার স্যুপঃ ঠাণ্ডা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে খেতে পারেন আদার স্যুপ। এটা আপনার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে জীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। যেকোনো ইনফেকশন সারিয়ে তুলতে আদার স্যুপ অতুলনীয়।

৩। হলুদ বা হলুদের গুড়াঃ হলুদ আমরা প্রতিদিনই রান্নার সাথে খেয়ে থাকি। কিন্তু ঠান্ডা সারাতে দুধের সঙ্গে এক টুকরা হলুদ জ্বাল দিয়ে বা মিশিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন। অল্প দিনেই বেশ উপকার পাবেন।

৪। এন্টি-হিস্টামিন জাতীয় ঔষধ সেবনঃ আপনার উপসর্গের উপর ভিত্তি করে আপনার ডাক্তার আপনাকে এণ্টি-হিস্টামিন জাতীয় ঔষধ সেবন করতে বলতে পারেন। এন্টি-হিস্টামিন এলার্জির ঔষধ হলেও এটা নাক বন্ধ হয়ে থাকা এবং হাঁচি ও কাশির উপশম করতে পারে।

৫। ভিটামিন সি জাতীয় সবজি ও ফল খাওয়াঃ ভিটামিন সি জাতীয় সবজি ও ফল ঠাণ্ডা সারাতে প্রত্যক্ষ ভুমিকা না রাখলেও পরোক্ষ ভুমিকা রাখে। ভিটামিন সি ডায়েট গলার ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। ভিটামিন সি এর ভালো উৎস হচ্ছে, লেবু জাতীয় ফল, কমলা, জাম্বুরা ও আমড়া। এছাড়াও আমলকী খাওয়া যেতে পারে। সব্জির মধ্যে ব্রকলি, ক্যাপ্সিকাম ও শাকে প্রচুর ভিটামিন সি আছে।

৬। প্রচুর পানি খাওয়াঃ এই মৌসুমটা যেহেতু শুষ্ক, তাই পানি খাওয়ার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। এছাড়াও ঠাণ্ডা লাগলে দেহ থেকে এম্নিতেই প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়। তাই দেহের চাহিদা পূর্ণ করার জন্য অনেক পানি পান করা প্রয়োজন। যদি খালি পানি খেতে ভালো না লাগে, তাহলে ফলের রস বা বিভিন্ন ডিটক্স ওয়াটার খেতে পারেন।

৭। নিয়মিত ভিটামিন গ্রহন করুনঃ আপনার প্রতিদিনের পর্যাপ্ত ভিটামিনের চাহিদা মিটছে কিনা, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ভিটামিন এ, ই, বি৬ ও বি১২ যাতে অবশ্যই থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। যদি ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া সম্ভব না হয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পারেন।

৮। ভিটামিন ডি এর জন্য সকালের নরম আলোঃ এটা ঠিক যে, ভিটামিন ডি এর জন্য আমরা সূর্যের আলোর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এজন্য, ট্যানিং বেড বা কৃত্রিম কখনোই ভালো নয়। বরং এ ধরণের আলোক রশ্মির কারণে ত্বকের ক্ষতি হয় এবং ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে।

৯। পর্যাপ্ত জিংক সেবন করুনঃ খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার রাখুন। যদি জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে এর পরিবর্তে জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন। জিঙ্কের ভালো উৎস হচ্ছে, চিংড়ি মাছ, গরুর গোশত ও খাসি বা ভেড়ার গোশত।

১০। প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাক-সব্জি খানঃ খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাক-সব্জি, ফল ও সালাদ রাখুন। এ ধরনের ব্যালান্সড ডায়েট শুধুমাত্র এন্টি-অক্সিডেন্ট সরবরাহ করবে না, যা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে, তার সাথে সাথে যেকোনো ধরণের প্রদাহ প্রতিরোধ করবে।

১১। কফ ও নাক বন্ধ হওয়া উপশম করে এমন ওষুধ সেবন করুনঃ আপনার যদি উচ্চ রক্তচাপ না থাকে, তাহলে কফ ও নাক বন্ধ হওয়া উপশম করে এমন ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। এজন্য স্টেরয়েড অনুনাসিক স্প্রে যেমন, ফ্লোনিস বা নসোনক্স ব্যবহার করতে পারেন।

১২। কফ সিরাপ সেবন করুনঃ কফ বা গলা খুসখুসের জন্য কফের সিরাপ সেবন করতে পারেন। হারবাল টনিক যেমন, বাসক বা তুলসী পাতার তৈরি সিরাপ খেলে উপকার পাবেন।

১৩। ব্যাথা ও জড়তা দূরকারী ওষুধ সেবন করুনঃ ঠান্ডা লাগলে অনেক সময় মাথার সাথে সাথে বুক ও শরীরে অস্বাভাবিক ব্যাথার সৃষ্টি হতে পারে। এ ধরণের ব্যাথা কমাতে ব্যথানাশক ঔষধ খেতে পারেন। এ ধরণের ব্যথা কমাতে এসিটামিনোফেন বা ইবুপ্রোফেন জাতীয় ঔষধ সেবন করতে পারেন।

১৪। ধৈর্য ধারন করুনঃ সাধারণভাবে ঠাণ্ডার ভাইরাস মানুষের দেহে ১০-১৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। তাই ধৈর্য ধারন করুন।

১৫। মানসিক চাপ কমানঃ মানসিক চাপের কারণে আপনার শরীরে স্ট্রেস হরমোন যেমন, কোর্টিসোল বা এড্রানালিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে। যা আপনার ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দিতে পারে, ফলে শরীর সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মানসিক চাপ কমাতে ইয়োগা, মেডিটেশনের সাহায্য নিতে পারেন, অথবা বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা বা কৌতুক করতে পারেন। এছাড়াও পোষা প্রানীর যত্ন নেয়া ও বাগান করলেও মানসিক চাপ অনেক কমে যায়।

১৬। কোন হাস্যকর বা মজার বিষয় দেখুনঃ হাসি-ঠাট্টা ও কৌতুকপূর্ণ জিনিষ মানুষের মানসিক চাপ কমাতে অনেক সাহায্য করে থাকে। মজার কোনও বিষয় দেখলে বা পড়লে আপনার মাথা থেকে এমনিতেই চাপপূর্ণ বিষয়গুলো দূর হয়ে যাবে। তাই মজার কোনও বিষয় দেখতে ব পড়তে পারেন।

১৭। হাসি খুশি থাকতে চেষ্টা করুনঃ সবসময় হাসি-খুশি থাকতে চেষ্টা করুন। হাসি না এলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলুন। মনে রাখবেন, আপনি কোন বিষয় নিয়ে যতই চিন্তা-ভাবনা ও মুখ ভার করে থাকেন না কেন, এতে সমস্যার সমাধান তো হবেই না উল্টো আপনার স্বাস্থ্য-ঝুঁকি তৈরি হবে।

১৮। চা পান করুনঃ ঠান্ডার সময় চা পান করুন। সবুজ চা অথবা ক্যামোমাইল চায়ে আছে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট, যা বিশেষ ধরণের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এছাড়াও মসলা চা, যেমন আদা চা পান করলে অনেক আরাম পাবেন।

১৯। প্রোবায়োটিক সেবন করুনঃ যেহেতু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ৭০% মানুষের পেটের উপর নির্ভর করে, তাই ভালো ব্যাক্টেরিয়া যেমন, দই খেলে মানুষের হজম শক্তি বাড়ে। যা পরোক্ষ ভাবে ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে থাকে। নিয়মিত দই খেলে ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস ইনফেকশনের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং যেকোনো ভ্যাকসিনকে ফলপ্রসূ করে তুলতে সাহায্য করে।

২০। চিকেন স্যুপ খানঃ অসুস্থ অবস্থায় মুরগীর গোশতের স্যুপ অনেক উপকারী। মুরগীর গোশতের স্যুপে থাকা অ্যামিনো এসিড ফুসফুসের মিউকাস দূর করতে সাহায্য করে। ফলে আপনি আগের চেয়ে ভালো বোধ করবেন।

২১। ঘরের আর্দ্রতা ঠিক রাখতে চেস্টা করুনঃ শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়ার ফলে আপনার অবস্থা আরও নাজুক হয়ে যেতে পারে। তাই এ সময়ে ঘরের আর্দ্রতা ঠিক রাখতে কৃত্রিম জলীয় বাষ্প বা হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন।

২২। কুসুম গরম পানিতে লেবু দিয়ে খানঃ কুসুম গরম পানিতে লেবু ও মধু মিশিয়ে খান। এতে আপনার খুসখুসে কাশি দূর হবে। একইসাথে ভিটামিন সি আপনার বুকে জমে থাকা কফ হালকা করতে সাহায্য করবে।

২৩। চিনি ও চিনি জাতীয় খাদ্য এড়িয়ে চলুনঃ চিনি কেবল আপনার শরীরে ক্ষতিকর মেদই বৃদ্ধি করবে না, সেইসাথে আপনার অসুস্থতার ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলবে। তাই চিনি জাতীয় খাদ্য এড়িয়ে চলুন।

২৪। সিপিএম জাতীয় ওষুধ সেবন করুনঃ ঠাণ্ডা থেকে তড়িৎ মুক্তি পেতে সিপিএম বা ক্লোরোফেনিরামিন জাতীয় ঔষধ সেবন করতে পারেন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনও ধরণের ঔষধই খাবেন না।

২৫। প্রচুর পরিমাণে এণ্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার খানঃ এণ্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার রোগ প্রতিরোধ করতে অত্যন্ত কার্যকর। এ ধরণের খাবার ঠাণ্ডার ফলে সৃষ্ট প্রদাহ ও চাপ দূর করে। বিভিন্ন ব্যারি জাতীয় ফল, শিমের বীজ ও এই জাতীয় শস্যে এবং সবুজ চায়ে প্রচুর এন্টি-অক্সিডেন্ট থাকে।

২৬। নিয়মিত নাক পরিস্কার করুন ও ধৌত করুনঃ ঠাণ্ডা লাগার ফলে নাক-মুখ বন্ধ হয়ে দম বন্ধ হবার মত অবস্থা হতে পারে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে নিয়মিত নাক পরিস্কার করুন ও ধৌত করুন। এজন্য আলাদা রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করতে পারেন।

২৭। দুগ্ধ জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুনঃ নাক দিয়ে যদি প্রচুর পরিমাণে মিউকাস বা পানি পড়তে থাকে, তাহলে এ অবস্থায় দুগ্ধজাত খাবার খাবেন না। কারণ এক রিসার্চে দেখা গেছে, দুগ্ধজাত খাবারের ফলে ঠাণ্ডা লাগলে মিউকাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়, যা আরও খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
সর্দি কমানোর অন্যান্য প্রতিকার সম্পর্কে জানতে নিচের বই তিনটি পড়ে দেখুনঃ