সেই দেশটা অনেক সুন্দর। শুভ্র, নীল এর আকাশ, নিপাট নিকশ কালো এর রাত। রাতের আকাশে যেন তারার ফুল ফুটে থাকে। অদ্ভুত আনন্দময় মনে হয় তখন পৃথিবীটাকে। যদি আকাশে চাঁদ থাকে।
জ্যোস্নার এক চাঁদোয়া যেন বিছানো থাকে। আকাশের গা বেয়ে নেমে আসা সেই চাঁদোয়ায় হাজারো শিশিরের বুনন দেখা যায়। এমনি এক নিকশ কালো রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেউ ছদ্মবেশে।
অদ্ভুত এই লোকটাকে কেউ চিনতে পারে না, যখন সে ছদ্মবেশে থাকে। বিরাট এক দায়িত্ব তার কাঁধে। আর রাতের বেলা সে দেখতে বের হয়, এই দায়িত্ব কতটুকু সঠিকভাবে পালন করছে সে।
আর সেজন্যই ছদ্মবেশ ধারণ করে সে রাতে ঘুরে বেরায়। কখনো একা, কখনো কোনো সহচর নিয়ে। সেই রাতে সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল নির্জন মরুভূমি বেষ্টিত এক এলাকায়, যেখানে সাধারণত কেউ থাকে না। কিন্তু তিনি হঠাৎ দেখতে পেলেন দূরে কোথাও আগুন জ্বলছে। সঙ্গে ছিল তাঁর এক খাদেম। তিনি তাকে বললেন চলো গিয়ে দেখে আসি কারা। হতে পারে কোন কাফেলা, রাত হয়ে যাওয়ার কারণে শহরে পৌঁছতে পারে নি, তাই এখানেই রয়ে গেছে। রাতে তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্রুতপদে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, এক মহিলা মলিনমুখে বসে আছে, একটু দূরে চুলায় আগুন জ্বলছে আর তার মধ্যে একটি হাড়ি চাপানো। আর মহিলার আশেপাশে কিছু শিশু কান্নাকাটি করছে।
লোকটি মহিলার কাছে গিয়ে বললেন, আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন, এই শিশুগুলো কাঁদছে কেন?
মহিলাটিঃ ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে কাঁদছে।
লোকটিঃ চুলায় হাড়িতে কি আছে?
মহিলাটিঃ পানি ভর্তি করে চুলার উপর রেখেছি, যাতে তারা দেখে কিছুটা স্বান্তনা পায় এবং ঘুমিয়ে পড়ে।
তারপর মহিলাটি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললঃ আমিরুল মুমিনিন উমর (রা) এবং আমার ফয়সালা আল্লাহর দরবারেই হবে। এ কথা শুনে লোকটি কাঁদতে লাগলো এবং বললঃ আমিরুল মুমিনিন তোমাদের অবস্থা কী করে জানবেন।
মহিলাটি বললঃ বাহ! তিনি আমাদের আমীর হয়েছেন আর আমাদের খবর রাখেন না।
এরপর লোকটি তাঁর খাদেমকে নিয়ে শহরে ফিরে গেলেন। এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কিছু খাদ্য শস্য এবং কাপড় বোঝাই করে খাদেমকে বললেন বোঝাটি আমার ঘাড়ে তুলে দাও।
খাদেম বলল, আমিই বহন করে নিয়ে যাই। কিন্তু তিনি কিছুতেই খাদেমকে তা বহন করতে দিলেন না। বারবার পীড়াপীড়ি করলে তিনি বললেনঃ কেয়ামতের দিনও কী এভাবে তুমি আমার গোনাহর বোঝা তোমার ঘাড়ে বহন করবে।
এরপর তিনিই সেই বোঝাটি বহন করে ঐ তাঁবু পর্যন্ত গেলেন, এবং নিজ হাতে রান্না করে বাচ্চাদেরকে খাওয়ালেন। বাচ্চারা পেট ভরে খানা খেয়ে আনন্দের সঙ্গে খেলাধুলা করতে লাগলো। আর লোকটি অবশিষ্ট খাবার পরের বেলার জন্য তাঁদের মায়ের হাতে তুলে দিলেন।
মহিলাটি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বললঃ আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন। হজরত উমরের পরিবর্তে তোমাকেই আমীর নিযুক্ত করা উচিত ছিল।
লোকটি তখন মহিলাটিকে স্বান্তনা দিয়ে বলল, কাল যখন তুমি উমরের কাছে যাবে তখন সেখানে আমাকেও দেখবে। তারপর কিছুদূর গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে তাদের অবস্থা দেখে উঠে চলে এলেন। খাদেম তাকে এরকম করার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, প্রথমে তাদেরকে কাঁদতে দেখেছিলাম, আমার মন চাইলো একটু হাসতে দেখে যাই।
সেই ছদ্মবেশী লোকটির নাম ছিল খলিফাতুল মুসলিমিন উমর (রা) যার শাসনামলে অর্ধেক পৃথিবীতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। অর্ধেক পৃথিবীর শাসক হয়েও তাদের কোনও নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় নি। কারন তারা যে তাদের জনগণের নিরাপত্তার কথা ভাবতেন এবং তাদের জন্য রাতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন।