উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর সময়কাল। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে সেনাপতি বানিয়ে রোমকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে একদল সৈন্য পাঠলেন। রোমের রাজা ছিলো খ্রিস্টান। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সবাই খ্রিস্টানদের হাতে বন্দী হয়ে গেলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে রাজার সামনে পায়ে ডাণ্ডা-বেড়ী ও হাতে শিকল পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এক ব্যাক্তি রাজাকে উদ্দেশ্য করে বললো, এই ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী।
একথা শুনে রাজা নিজের রাজ সিংহাসন ছেড়ে উঠে আসলেন। তারপর সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। একসময় তার কাছাকাছি এসে আস্তে করে বললেন, যদি তুমি খ্রিস্টান হয়ে যাও, তাহলে আমি তোমাকে রাজপরিবারের অংশ করে নিবো। আর তোমাকে আমার রাজত্ব থেকে কিছু অংশ দিয়ে দিবো।
তখন তিনি খুব দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করলেন ও বললেন, তোমার রাজত্ব তো তুচ্ছ, যদি আমাকে সমগ্র আরবের যত ধন-সম্পদ আছে, তাও সামনে এনে দেয়া হয়, তবুও আমি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করবো না। একথা শুনে সে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে বললো, তাহলে আমি তোমাকে হত্যা করবো।
তিনি জবাবে বললেন, তোমার যা মন চায়, তুমি তা করতে পারো। এবার তিনি তার সৈন্যদেরকে বললেন, একে আমার সামনে ক্রুশ বিদ্ধ করো। তাকে ক্রুশের সাথে বাঁধা হলো। এবং একদল তীরন্দাজ তার হাত পা লক্ষ্য করে তীর ছুড়তে শুরু করলো। আর রাজা তার পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে এই অবস্থাতেও তাঁকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো।
কিন্তু, তিনি এতকিছুর পরও ইসলাম ছাড়তে রাজি হলেন না। কিছুক্ষন পর বাদশাহ বললেন, তাঁকে উপর থেকে নীচে নামাও। এবার তাঁকে উপর থেকে নিচের দিকে ফেলে দেয়া হলো। এবার বাদশাহ একটি বড় ডেকচীতে তেল গরম করতে বললেন এবং দুজন মুসলিম বন্দীকে ধরে আনতে বললেন, তার কথামত দুজনকে ধরে আনা হলো। একজনের ব্যপারে আদেশ করা হলো, যে একে গরম তেলে নিক্ষেপ করো। সাথে সাথে তাঁকে গরম তেলে ছেড়ে দেয়া হলো।
এই টগবগ করতে থাকা তেলে সে একেবারে ফ্রাই হয়ে গেলো। তার গোশত ও হাড্ডি আলাদা হয়ে গেলো। খ্রীস্টান রাজা এবার আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফাকে বললেন, দেখো এখনো সময় আছে, তুমি খ্রিস্টান হয়ে যাও। কিন্তু তিনি এবার আগের চেয়েও কড়া ভাষায় অস্বীকার করলেন। এবার বাদশাহ তাঁকে বললেন, একেও উত্তপ্ত তেলের মধ্যে ফেলে দাও।
যখন সৈন্যরা তাঁকে গরম তেলের ডেগচীর কাছে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। এবং তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এক ব্যক্তি বাদশাহর কাছে দৌড়ে গিয়ে বললো, বাদশাহ, জাহাঁপনা! মুসলিম বন্দীটি কাঁদছে। বাদশাহ মনে মনে ভাবলেন, সে হয়তো মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছে। তাই জোরে একটি অট্টহাসি দিয়ে বললেন, তাঁকে ফেরত নিয়ে আসো।
যখন তাঁকে ফিরিয়ে আনা হলো, তখন বাদশাহ আবার তাঁকে খ্রিস্টান হতে আহবান জানালো। তিনি আগের মতই অস্বীকার করলেন। বাদশাহ এবার অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, তাহলে তুমি কাঁদলে কেন? আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবার বললেন, আমি এইজন্য কাঁদলাম যে, আমার ত মাত্র একটা প্রান, যা ডেকচিতে ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে শেষ হয়ে যাবে। আমার আন্তরিক কামনা হলো যে, যদি আমার শরীরে থাকা অসংখ্য পশমের সমান প্রাণও থাকতো, তবুও আমি এগুলো সব এক এক করে আল্লাহর পথে দিয়ে দিতাম।
একথা শুনে বাদশাহ কিছুক্ষন মাথা নিচু করে ভাবতে থাকলেন, তারপর বললেন, তোমাকে আমি মুক্তি দিতে পারি, তবে এক শর্তে। যদি তুমি আমার মাথায় একটা চুমু দাও। হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবার বললেন, শুধু আমাকে নয়, আমার সাথে যারা বন্দী আছে, সবাইকে মুক্তি দিতে হবে। বাদশাহ বললো, ঠিক আছে আমি সবাইকে মুক্তি দিয়ে দিবো। একজন অত্যাচারী, জালিম বাদশাহের মাথায় চুমু দেয়া সহজ কাজ নয়।
কিন্তু, আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু অন্তরে ঘৃণা রেখে তার মাথায় নিজের ঠোঁট স্পর্শ করালেন। মনে মনে ভাবলেন, যদি একারণে যদি সমস্ত বন্দী মুক্তি পেয়ে যায়, তাহলে অসুবিধা কোথায়? বাদশাহ তার কথা রেখেছিলেন, সব বন্দীসহ তাঁকেও মুক্ত করে দিলেন। ইবনে হুজাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন সবাইকে নিয়ে উমর ইবনুল খাত্তাবের নিকট পৌঁছুলেন, তখন আদ্যপান্ত পুরো ঘটনা তাঁকে খুলে বললেন।
সব শুনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তার চেহারা আনন্দের আতিশয্যে চমকে উঠলো। তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললেন, তোমরা সবাই আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মাথায় চুমু দাও। আর শুরু আমিই করছি। সুতরাং উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু উঠলেন, সামান্য ঝুঁকলেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহুর বুদ্ধিমত্তায় খুশি হয়ে তাঁর মাথায় আনন্দ চুম্বন একে দিলেন।
(কানযুল উম্মাল ও চার খলীফার চারশ ঘটনাবলী অবলম্বনে লিখিত)