আস্ত একটা মুরগীর রান খেয়ে আয়েশী ঘুম দিলো মীরা। অন্য সব ধরণের গোশতের মধ্যে মুরগীর গোশত তার কাছে ভীষণ প্রিয়। দুপুরের ভাতঘুমে কখন যে হারিয়ে গেলো, কিছুই মনে নেই। ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সে এক অচীন গ্রামে পৌঁছে গেলো।
সেখানে বড় বড় ডেকচীতে রান্না হচ্ছে মানুষের গোশত। আর বিশাল বিশাল মুরগীরা সেসব গোশত পরিবেশন করছে। মীরার চোখ বড় হয়ে গেলো এই দৃশ্য দেখে। দৌড়ে কাছের এক ঝোপে গিয়ে লুকালো সে। আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
হঠাৎ তার চোখ পড়লো পিছনের খাঁচায়। সেখানে আটকে রাখা হয়েছে অনেকগুলো মানুষকে। মানুষগুলোর চোখ দেখলেই বুঝা যায়, তাঁরা মোটেই শান্তিতে নেই। আর তাঁদের খাবারের সাথে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে ঘুমের ওষুধ।
মোটাতাজাকরণের ওষুধ দেয়াতে মানুষগুলো বেশ নাদুস-নুদুস। কিন্তু তাঁদের চোখগুলো অসুখী। সেখানে বন্দিত্ব আর অসহায়ত্বের ছায়া। ঝিমুচ্ছে তাঁরা। আর হরমোন ইনজেকশনের প্রভাবে তাঁরা খুব দ্রুত বাড়ে আর অনেক খায়।
একসময় মানুশগুলোকে নিয়ে জবাই করে রান্না করছে বড় বড় মুরগীরা। আর মানুষের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে তাঁরা কৃত্রিম উপায়ে লালন-পালন করছে।
এই মুরগীগুলো বেশ আধুনিক। একটা একটা করে বাচ্চাকে খাওয়ানোর পিছনে সময় নষ্ট করতে চায় না তাঁরা। বাচ্চার মায়েদের কাছেও তাঁদের বাচ্চা পালতে দেয়া হয় না।
তার বদলে বাচ্চাগুলোকে একসাথে শোয়ানো হয়, একটা অটোমেটিক মেশিনে দুধজাতীয় কিছু খাবার ভরা হয়। তারপর তা বাচ্চাদেরকে খেতে দেয়া হয়। খাবারের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় ঘুমের ওষুধ। তাই বেশিরভাগ সময়েই বাচ্চাগুলো কেবল ঝিমুতে থাকে।
শুধু এটাই নয়। ছেলে বাচ্চাদেরকে মেরে ফেলা হয় ছোট থাকতেই। কারণ তাঁরা তো আর নতুন মানুষ উৎপাদন করতে পারবে না। তাই মানুষের খাঁচায় কেবল মেয়েদেরকেই দেখতে পেলো মীরা।
এতসব দেখে মীরা আর সহ্য করতে পারলো না। চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আশ্চর্য! মীরা যেই না চিৎকার করে উঠলো ওমনি দেখতে পেলো, এক মুরগী তার দিকে এগিয়ে আসছে।
মুরগীটা এসে মীরাকে বললো, ওহহো! তুমিই তাহলে সেই মানুষ! যারা আমাদের সাথে ঠিক একই আচরণ করো। কই আমরা তো এরকম চিৎকার করি না। তোমাদের দেয়া শত শত কষ্ট, অবিচার ও অনাচার আমরা মাথা পেতে নেই। কোনদিন তো প্রতিবাদ করি না।
আমরা তো বলি না, তোমরা কেন আমাদেরকে খাঁচায় আটকে রেখেছো? কী অধিকার আছে, তোমাদের আমাদের সাথে এই অবিচার করার? কেন আমাদেরকে কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদন করছো? আমাদের কি মায়ের স্নেহ পেতে ইচ্ছা করে না? আমাদের কি এই পৃথিবীর আলো-বাতাস ও মাটিতে চড়ে নিজের খাবার খুঁটে খেতে ইচ্ছে করে না?
হ্যাঁ, আমাদের এসব পেতে ইচ্ছা করে। আমরা কৃত্রিম অবস্থার মধ্যে প্রতিপালিত হতে চাই না। তোমরা আমাদেরকে জবাই করো, রান্না করো, খাও। সব ঠিক আছে।
কিন্তু আমাদেরকে কৃত্রিমভাবে লালন-পালন করো না। যেখানে আমরা জানবো না। কে আমাদের মা। কে আমাদের বাবা। মায়ের স্নেহ কি? মায়ের আদর কি জিনিষ? মায়ের ভালবাসা কেমন হয়। মায়ের দেহের উষ্ণতা কেমন হয়। এসব কিছুই আমরা জানবো না। আমরা শিখবো না কিভাবে খাবার খুঁজে খেতে হয়, কিভাবে লড়াই করতে হয়।
সন্তানের জন্য আমাদের কোনও মায়া-দয়া থাকবে না। আমরা শুধু উৎপাদনশীল হবো। আর জানবো কেবল উৎপাদন করতে আর খেতে। আমরা তোমাদেরকে কেবল ডিম দিবো। তোমরা বিনিময়ে আমাদেরকে খাবার দিবে, এজন্যই কি তোমরা আমাদেরকে এভাবে লালন-পালন করছো? আর তোমরা কি বলে থাকো, এজন্যই আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে?
তবে হ্যাঁ, শুনে রাখো, এটাই যদি তোমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়, তবে তোমরা আমাদের উপর যেই অবিচার করছো, তা তোমাদের জীবনেও প্রতিফলিত হবে। একদিন তোমাদের বাবা-মায়েরা শিশুদের প্রতি হৃদয়হীন হয়ে যাবে। যেমন আজকে আমদের ডিম চোখের সামনে থেকে নিয়ে গেলেও আমাদের কোনও ভাবান্তর হয় না।
তোমাদের শিশুরাও একদিন জানবে না বাবা কে? আর মা কে? মায়ের স্নেহ কেমন? মায়ের গন্ধ কেমন? মায়ের ভালবাসা কী? তাঁরা কেবল উৎপাদনের পিছনেই ছুটবে।
আজকে আমাদের সন্তানদেরকে যেমন তোমরা খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে একসাথে লালন-পালন করছো। যেখানে তাঁরা মায়ের আদর ও স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একদিন তোমাদের সন্তানেরাও এভাবে প্রতিপালিত হবে। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এক জায়গায় অনেকগুলো বাচ্চাকে লালনপালন করা হবে।
কেউ চাইল্ডকেয়ারের নামে, কেউ সেফহোমের নামে, কেউ ছাত্র হোস্টেলের নামে। সেখানে থাকবে না মায়ের ভালবাসা, বাবার আদর ও স্নেহ। ভাইবোনদের সাথে দুষ্টামি আর খুনসুটি। সবাই কেবল ঊর্ধ্বমুখী এক উন্নয়ন আর উৎপাদনের পেছনে ছুটবে। কিন্তু তাঁদের ভিতর বিবেকবোধ ও মানবতা হয়ে যাবে নিন্মমুখী।
উন্নত জীবন থাকবে, কিন্তু উন্নত মানবতা থাকবে না। মানুষ হয়ে যাবে পশুর মত। বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট।
রক্ত পিপাসু পিরানহার মত। যারা নিজের গোত্রের মাছের গায়েও রক্তের নিশানা পেলে তা খেয়ে শেষ করে দেয়।
শুনে রাখো, তোমাদের সেই সভ্যতায় মা, যিনি বাচ্চার জন্য পরম মমতা ও নির্ভরতার স্থল, তার কোলে বাচ্চা নিরাপদ থাকবে না।
ঘর, যা মানুষের আশ্রয়ের কেন্দ্র, শান্তির আবাস, তাতে বিন্দু পরিমাণ শান্তি থাকবে না।
ডাক্তার, যিনি শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার চিকিৎসা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার কাছে রোগী নিরাপদ থাকবে না।
শিক্ষক, যিনি ন্যায় ও নীতির মানদণ্ড শেখাবেন, তার কাছ থেকে ছাত্ররা ভালো কিছু শিখবে না।
দুটি দেহ এক ছাদের নিচে থাকবে, কিন্তু তাঁদের আত্মা একজন আরেকজন থেকে বহু বহু দূরে থাকবে।
অর্থ ও বিত্তের মাপকাঠিতে মানুষের সম্মান নির্ধারিত হবে। মানুষ একজন অন্যজনের সাথের সম্পর্ক করবে শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য। তোমাদের কারও ভিতর মায়া ও মমতা থাকবে না। কোনও দায়িত্ববোধ ও স্নেহ থাকবে না। বলো, এমন জীবন কি তোমরা চাও?
মীরার চোখ উপচে পরছিলো পানির স্রোত। কন্ঠের ভিতর একবুক কান্না কেবল দলা পাকিয়ে আটকে ছিলো। অনেক কষ্টে বললো, না! চাই না? এমন জীবন আমরা কখনোই চাই না? কোনভাবেই চাই না।
কিন্তু…শোনো। আমাদেরকে দোষ দিও না। আমাদের আসলে কোনও দোষ নেই। আমাদের শহুরে জীবন তোমাদের মতোই। তোমরা থাকো লোহার খাঁচায়। আমরা থাকি ইটের খাঁচায়।
আমাদের এখানে উঠান নেই যে, তোমাদেরকে স্বাধীনভাবে পালবো। তোমরা উঠানে চড়ে-ফিরে খাবার খুঁটে খাবে। তাই আমাদেরকে দোষ দিও না। পারলে আমাদেরকে ক্ষমা করে দিও। কারণ শহুরে বাস্তবতায় এত আদরের সাথে তোমাদেরকে লালন-পালনের সাধ ও সাধ্য কোনটাই আমাদের নেই।
আমরা যখন তোমাদেরকে ক্রয় করি, তখন আসলেই এটা জানি না যে, তোমাদের সাথে কি কি করা হয়। কিভাবে প্রতিপালন করা হয় আর কিভাবে খাওয়ানো হয়।
মাসের শেষে আমাদের হাতে কিছু চকচকে নোট আসে, আমরা সেগুলো দিয়ে তোমাদেরকে কিনে আনি ও খাই। না খেলে আমরা কি করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটবো, বলো? আমরা কি খাচ্ছি, এতকিছু ভাবারও সময় থাকে না।
পারলে আমাদেরকে ক্ষমা করে দিও, কারণ আমরাও তোমাদের মত অসহায়!
মীরার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মীরার আর কোনও ভাই-বোন নেই। মীরার বাবা ও মা দুজনেই কর্মজীবী। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসেন। মীরার খুব শখ হলো একটা মুরগীর বাচ্চা পালতে। স্কুলের সামনে থেকে ১৫ টাকায় একটা বাচ্চা কিনে আনলো সে।
কিছুদিন ভালোই গেলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকাল থেকে বাচ্চাটা কিছুই খাচ্ছে না। হঠাৎ করে সটান হয়ে চোখ উল্টে মরে গেলো। মীরার চোখে পানি চলে এলো। বারান্দার টবে বাচ্চাটাকে কবর দিয়ে বিরবির করে বলল, “ক্ষমা করে দিস মুরগী। আমরা মানুষরা তোদের উপর সত্যিই অনেক অত্যাচার করি।”