হ্যান্ড এমব্রয়ডারি বা হাতের কাজ হচ্ছে এমন এক দক্ষতা যা একজন মানুষ একবার শিখলে সারা জীবন মনে রাখতে পারে। মোটামুটি শৈশবকাল থেকেই এই দক্ষতা আপনি আয়ত্ত করতে পারেন। এবং সারা জীবন এই দক্ষতাটি কাজে লাগিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিষ তৈরি করা যায়।
হাতের কাজ শেখার আগ্রহ থাকলে আপনি ধীরে ধীরে আপনার এই দক্ষতাকে আরও উন্নত করতে পারবেন। যেকোনো কাজে লেগে থাকার আলাদা একটি সুফল থাকে। হ্যান্ড এম্ব্রয়ডারি বা হাতের কাজও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। কাজে লেগে থাকলে আপনার সেলাইয়ের মোটিফ এবং কারুকাজ আরো সুন্দর হবে, এবং আপনি আগের চাইতেও আরও সুন্দর ডিজাইন তৈরি করতে পারবেন।
এটি এমন এক শিল্প যা আপনার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করবে, এবং হাতের কাজ শুরু করার পরই আপনি আসলে এই বিষয়টি বুঝতে পারবেন। হাতের কাজ সুচারুভাবে করার জন্য নানা ধরনের সূচিকর্মের পাশাপাশি বেশ কিছু টেকনিক বা কৌশলেরও প্রয়োজন হয়।
আজকাল সাধারনত যেসব এমব্রয়ডারি টেকনিক ব্যবহার করা হয়, তা নিচে দেয়া হলোঃ
অ্যাপ্লিকঃ এটি হচ্ছে হাতের কাজের অন্যতম একটি ডেকোরেটিং টেকনিক। এটা কাপড়, পতাকা, কুয়েল্টিং এবং আরও অনেক কাজেই ব্যবহার করা হয়। অ্যাপ্লিক করতে আপনাকে শুরুতে আলাদা রং ও ডিজাইনের বেশ কিছু কাপড় একত্রে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নে জোড়া লাগাতে হবে। তারপর আপনি এই কাপড়ের টুকরাগুলো দিয়ে কাপড়ের ধার মুড়িয়ে দিবেন।
এটা করতে আপনি বিভিন্ন ধরনের সারফেস স্টিচ ব্যবহার করতে পারেন। যেমন, কাউচিং, স্টেম স্টিচ, কর্ড স্টিচ, এমনকি বাটনহোল স্টিচও ব্যবহার করতে পারেন। এই কাজ করার পর যাতে সৃজনশীলভাবে কাজটি ফুটে উঠে, সেজন্য সম্পূর্ণ আলাদা ও বিপরীত রঙের কাপড় ব্যবহার করতে হবে। এই টেকনিক আসলে বড় কোনও কাপড় যেমন, বিছানার চাদর, সোফার কভার, পর্দা, কাপড়ের ডীভান কভার, কাপড়ের ম্যাট ইত্যাদির জন্য কাজে লাগে। এতে ডিজাইন খুব সুন্দর ও ভালোভাবে ফুটে উঠে।
ব্ল্যাকওয়ার্কঃ এটা আরেকটি অসাধারন এম্ব্রয়ডারি টেকনিক যা আপনি বেলফেস্ট লিলেন বা ইটামিন তুলার উপর করতে পারবেন। এই টেকনিক ব্যবহার করে সমান্তরাল, লম্বালম্বি বা কোনাকুনি স্টিচের সাহায্যে এমন কিছু সুন্দর এবং ইন্টারেস্টিং প্যাটার্ন করা হয়, যা দিয়ে অসাধারণ সব ডিজাইন তৈরি করা সম্ভব হয়।
যদিও এই টেকনিকের নাম ব্ল্যাকওয়ার্ক, তারমানে এই নয় যে, আপনাকে কেবল কালো সুতাই ব্যবহার করতে হবে। আপনি চাইলে নানা ধরনের এমব্রয়ডারি ফ্লসের মিশ্রণ, এমনকি মেটালিক সুতা দিয়েও এই কাজটি করতে পারেন, যা দিয়ে আরও ভালো ফলাফল পাবেন।
এই টেকনিক দিয়ে আপনি গাড় ও হালকা বিভিন্ন ধরনের শ্যাড তৈরি করতে পারবেন। এমনকি কোনও বিশেষ প্যাটার্নে বেশ কিছু স্টিচ বাদ পড়ে গেলে বা খালি দেখালে ব্ল্যাকওয়ার্ক দিয়ে সেই জায়গাটি ভরাট করা সম্ভব। আপনি যদি একটি অনুক্রমিক স্টিচে এই কাজটি কাপড়ের উপর করে যান, তাহলে কাপড়ের সোজা পিঠ ও উল্টা পিঠ একই রকম দেখাবে। ক্রস স্টিচে দক্ষ হলে আপনি এই টেকনিকটি খুব সহজেই করতে পারবেন।
ক্যানভাসওয়ার্ক টেকনিকঃ এটি একটি নির্বাচিত ক্যানভাসে বিভিন্ন সুচিকর্মের কৌশলের সমন্বয়। এই কৌশলের তৈরি নকশা খুব মজবুত ও শক্তিশালী হয়ে থাকে। এই ধরনের কৌশলগুলো আপহোলস্ট্রি, কুশন কভার, দেয়ালচিত্র বা এই ধরনের প্রজেক্টে ব্যবহার করা হয়, যা সাধারনত অনেকদিন ধরে টিকে। সৌন্দর্যের কারণে এই ধরনের হাতের কাজ মানুষের কাছে বেশ সমাদৃত হয়।
ক্যানভাসওয়ার্ক টেকনিকের অধীনে আরও কিছু টেকনিক আছেঃ
পেইন্টেড ক্যানভাসঃ এতে ডিজাইনটি কাপড়ের ক্যানভাসের উপর পেইন্ট করা হয়। এবং তার উপরে সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়। এক্ষেত্রে পেইন্টিং অনেকটা প্যাটার্ন হিসেবে কাজ করে। এ ধরনের কাজে নিডলপয়েন্ট স্টিচ সবচেয়ে ভালো হয়।
ক্যানভাস স্টিচঃ জ্যামিতিক বিভিন্ন প্যাটার্ন ব্যবহার করে ক্যানভাস ওয়ার্ক স্টিচ দিয়ে অসাধারণ সব ডিজাইন তৈরি করা যায়। ক্যানভাস স্টিচের ক্ষেত্রে আপনি বেশ কিছু স্পেশাল সুতা ব্যবহার করতে পারেন, তা হচ্ছে রঙিন মোটা সুতা, পার্লে কটন সুতা এবং মেটালিক সুতা।
বারগেলোঃ এই কৌশলে, সোজাসুজি ফ্লোরেন্টাইন স্টিচ ব্যবহার করে একটি রৈখিক বা জ্যামিতিক প্যাটার্ন তৈরি করতে হবে। এই কৌশল ব্যবহার করে আপনি জিগজাগ অথবা ঢেউ খেলানো ইফেক্ট তৈরি করতে করতে পারবেন। এমনকি চাইলে আপনার প্রজেক্টে এটা দিয়ে আগুনের শিখাও তৈরি করা সম্ভব।
এই কৌশলটি বেশ পুরোনো। কিন্তু আপনি আধুনিক ফ্লস সুতা, মেটালিক সুতা এবং আপনার পছন্দমত নানা ধরনের রং ব্যবহার করে এতে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দিতে পারেন।
ব্রাজিলিয়ান টেকনিকঃ এটা হচ্ছে সারফেস এমব্রয়ডারি টেকনিক যা বিভিন্ন ধরনের এমব্রয়ডারি স্টিচের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। এ ধরনের এমব্রয়ডারি রেয়ন সুতা ব্যবহার করে সুতি, সিল্ক অথবা পলিয়েস্টার কাপড়ে তৈরি করা যায়। এখানে ব্যবহৃত নকশা সাধারনত ফুল-পাতার সমন্বয়ে তৈরি হয়ে থাকে। সাধারনত উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী ডিজাইন তৈরি করার উদ্দেশ্যেই ব্রাজিলিয়ান এমব্রয়ডারী কৌশল ব্যবহার করা হয়। রেয়ন সুতা বেশ শক্তিশালী। আর একারনেই এটা বিভিন্ন ধরনের ফেব্রিক এবং এরিয়া যেমন কাপড়, লিলেন এমনকি বালিশের কভারেও ব্যবহার করা হয়। ব্রাজিলিয়ান এম্ব্রয়ডারীতে আপনি বিভিন্ন ধরনের স্টিচ যেমন, লং টেইল ফ্রেঞ্চ নট, দ্রিজিল স্টিচ, বাটনহোল স্টিচ, স্টেম স্টিচ, কাউচিং এবং লিফ স্টিচ ব্যবহার করতে পারেন। এগুলোর প্রতিটি ফুল পাতার একেক ধরনের নকশা ফুটিয়ে তুলতে কাজে লাগে।
ক্রস স্টিচ এবং নিডল পয়েন্টঃ নতুন যারা এমব্রয়ডারি করতে শুরু করে এবং খুব দ্রুতই কোনও অসাধারণ এমব্রয়ডারি নকশা তৈরি করতে চায়, তাঁরা এই কৌশলটি শিখতে পারে। এর আগে আমি উপরে নিডল পয়েন্ট স্টিচ নিয়ে আলোচনা করেছি এটা হচ্ছে আড়াআড়িভাবে সুতার বুনন অনুযায়ী সেলাই করে যাওয়া। তবে, একপাশ থেকে আড়াআড়ি সেলাই করাকে নিডলপয়েন্ট স্টিচ বলা হলেও অন্যপাশ থেকে সেলাই করে ক্রস তৈরি করাই হচ্ছে ক্রস স্টিচ। সাধারণত লিলেন অথবা আইদা ফেব্রিকে এই ধরনের ডিজাইনের কাজ সুন্দরভাবে ফুটে উঠে।
ক্রসস্টিচ ও নিডলপয়েন্ট স্টিচ ব্যবহার করে যে কোনও ধরনের ডিজাইন ও প্যাটার্ন তৈরি করা সম্ভব। তবে এজন্য কয় ঘর কি রঙের সুতা দিয়ে ভরতে হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। প্রথমে খুব সিম্পল ও সাধারণ ডিজাইন নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন, যা ছোট বাচ্চারাও অনায়াসে করতে পারে। এরপর আরো জটিল ও কঠিন ডিজাইন তৈরি করতে রঙের মিশ্রণ ও অনেক অনুশীলন ও ধৈর্যের প্রয়োজন হবে।
উপরের কৌশলগুলো আয়ত্তে এসে গেলে আপনি আরো কঠিন ও জটিল ধরনের ডিজাইন খুব সহজেই প্রস্তুত করতে পারবেন। এমনকি নিজস্ব ডিজাইন ও কৌশল তৈরি করাও খুব সহজ ও সাবলীল কাজ মনে হবে।