Skip to content

বাংলাদেশে প্রচলিত বস্ত্র সম্পর্কিত হস্তশিল্প

তাঁতের বস্ত্র বোনার জন্য তৈরি তাঁতযন্ত্র

বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশে এদেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী বস্ত্র হচ্ছে সুতি বস্ত্র। সাধারনত প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশে তুলার চাষ করা হয়। তুলা একধরনের গাছের ফল থেকে প্রাপ্ত তন্তু, যা পাকার সাথে সাথে ফেটে সাদা ধবধবে মাখনের মত মসৃণ তন্তু বের হয়। এসব তন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাকিয়ে সুতা তৈরি করা হয়। যা থেকে সুতি বস্ত্র উৎপন্ন হয়।

সুতি বস্ত্র খুব মিহি ও তাপ সহনীয়। এ বস্ত্র দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে। তাই এই বস্ত্র পরিধান করলে কখনোই গরম অনুভুত হয় না। বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্প মূলত তুলার উপর নির্ভরশীল। ইদানিং লিলেন তন্তুও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।

সুতি বস্ত্র কিভাবে চেনা যায়

সুতি বস্ত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট আছে, যা দেখে সুতি বস্ত্র চেনা যায়। তা নিচে দেয়া হলোঃ

  • সুতিবস্ত্র আগুনের উপর ধরলে সাথে সাথে পুড়ে মিহি ছাই হয়ে যায়।
  • এই বস্ত্র খুব দ্রুত পানি শুষে নিতে পারে।
  • সুতি বস্ত্র পানিতে ভেজালে এর শক্তি বেড়ে যায়।
  • সুতি কাপড়ের সুতা ছিড়লে এর প্রান্ত অনেকটা তুলির মতো দেখায়।
  • এ কাপড় মোচড়ালে কিছুটা কুঁচকে যায় আবার টান টান করলে ঠিক হয়ে যায়।
  • সোডার দ্রবণে ভেজানো হলে হলদে দাগ পড়বে না।
  • কাপড়ের উপরিভাগে হাত বুলালে কিছুটা খসখসে অনুভুত হবে।

লিলেন ও সুতি একই ধরণের বস্ত্র হলেও বাংলাদেশের আবহাওয়ায় লিলেনের চেয়ে সুতিই বেশী চলে। কারনঃ

  • সুতি কাপড় লিলেনের তুলনায় হালকা হয়।
  • সহজে রোদে শুকায়।
  • ধোয়া ও ব্যবহার করা সহজ।
  • তন্তু নরম না হওয়া পর্যন্ত সহজে ছিঁড়ে না।

সুতিবস্ত্র ঘিরে যেসব শিল্প বাংলাদেশে প্রচলিত, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেঃ

ব্লকঃ

কাপড়ে ছাপ দিয়ে রং করার পদ্ধতিকে ব্লক বলা হয়। ব্লক করার পদ্ধতি খুব সহজ। এটা অনেকটা কাগজে ছাপ দেয়ার মতই। তবে ব্লকের ক্ষেত্রে কাঠের ব্লকের নিচে কাগজের পরিবর্তে কাপড় থাকে। সাধারণত কাঠের টুকরাতে বিভিন্ন ধরণের নকশা এঁকে তা খোদাই করা হয়। তারপর তা বেশ মসৃণ ও সমান্তরাল করে ঘষে নেয়া হয়।

অন্যদিকে, কাঠের ফ্রেমে কাদামাটি লেপে তার উপর চট বা ভারী ধরণের মোটা কাপড় বা স্পঞ্জ দেয়া হয়। সবশেষে রং তৈরি করে তা ঢেলে নেয়া হয়। এবং কাঠের ব্লকের সাহায্যে তাতে কয়েকবার রং লাগিয়ে কাপড়ে ছাপ মারা হয়।

ব্লক করার পর কাপড় কড়া রোদে দিয়ে শুকানো হয়। রঙে সাধারণত এম এল সি, পানি, বাইণ্ডার, ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট, গ্লিসারিন, রং, কেরোসিন ও ফিক্সার বিভিন্ন অনুপাতে মেশানো হয়, যার ফলে রঙ পাকা হয়ে যায় ও সহজে উঠে না।

টাই-ডাইঃ

কাপড় বেঁধে রং করার পদ্ধতিকে টাই-ডাই বলে। এ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট স্থান পর পর কাপড় সুতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। এছাড়াও, কাপড়ের উপর নকশা এঁকে সুঁই ও সুতা দিয়ে সেলাই করে সুতা টান দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নানা রঙের রং ঢালা হয়। শুকিয়ে গেলে তারপর লবণ বা সোডাযুক্ত পানি দিয়ে সিদ্ধ করা হয়। সবশেষে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়।

বাটিকঃ

বাটিক টাইডাইয়ের মতই একটি পদ্ধতি। তবে, এতে মোম দিয়ে নকশা করার পর রং স্প্রে করে বা ডুবিয়ে কাপড়ে নকশা তৈরি করা হয়। টাইডাইয়ে যেমন বাধাই করে রং প্রবেশে বাঁধা দেয়া হয়, বাটিকের ক্ষেত্রে একই কাজটি মোম দিয়ে করা হয়। রংয়ের পানিতে কাপড় নাড়াচাড়া করার সময় তা কিছুটা ফেটে যায়। ফলে খুব সুন্দর ও সুক্ষ্ম ডিজাইন তৈরি হয়। বাটিক করতে প্রয়োজন হয় সাদা মোম, মধু মোম, রজন ও ফাইন গাম। এছাড়াও উপকরণ হিসেবে ছবি আঁকার বিভিন্ন উপকরণ, মোম লাগানোর নরমাল ব্রাশ, মোম লাগানোর জান্টিং ব্রাশ, রং লাগানোর ব্রাশ ও টান টান করে কাপড় আটকিয়ে রাখার জন্য ফ্রেম দরকার হয়।

এম্ব্রয়ডারিঃ

কাপড়ে নক্শা করার জন্য সুতা দিয়ে কারুকার্য তৈরি করা একটি প্রাচীন শিল্প। এটা হাতের কাজ বা এমব্রয়ডারি হিসেবে পরিচিত। সুতির কাপড়ের উপর সুক্ষ্ম কারুকাজ ও নকশা তুলে অনেক মেয়েরাই তাঁদের অবসর সময় পার করে থাকেন। জামা বা শাড়ির উপর কারুকাজ তুলে অনেকে বিক্রিও করে থাকেন। তবে, অনেক ধরণের ফোঁড় ও কলা কৌশল সম্পর্কে জানতে হয়। কাপড়ে সাধারণত যেসব কাজ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রান ফোঁড় (প্রচলিত ভাষায় যাকে কাঁথা স্টিচ বলা হয়), কাশ্মিরী স্টিচ, স্যাটিন স্টিচ, অ্যাপ্লিক ওয়ার্ক, হেম ফোঁড়, বাটন ফোঁড়, হেরিংবোন স্টিচ ও শ্যাডো ওয়ার্ক।

তাঁতঃ

তাঁত কেবল কাপড় বোনার পদ্ধতিই নয়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন নকশাও ফুটিয়ে তোলা হয়। আমাদের দেশে জামদানি ও বেনারসি শাড়ী কেবল তাঁতে বোনাই হয় না। পাশাপাশি কাপড়ের উপর নকশাও করা হয়। তাই এটা একটি শৈল্পিক কাজ এবং একটি সমাদৃত শিল্প। যদিও আজকাল কলের শিল্পের প্রভাবে তাঁতশিল্প অনেকটাই সংকুচিত হওয়ার পথে রয়েছে, কিন্তু তারপরও আধুনিক কলা কৌশল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে এই শিল্পকে সম্প্রসারণ করার যথেষ্ট সুযোগও আছে।

উপসংহারঃ

এই হচ্ছে বাংলাদেশে বস্ত্র সম্পর্কিত শিল্পের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এছাড়াও বাংলাদেশে বস্ত্র সম্পর্কীয় আরো অনেক শিল্প আছে। বর্তমান সময়ের গা্র্মেণ্ট শিল্প এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে বহু নদনদী থাকায় গা্র্মেণ্ট শিল্পের কারনে তৈরি হওয়া বর্জ্য সহজেই দূর করা যায়। এছাড়াও এখানকার শ্রমিকের মজুরী পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। আর এসব কারনেই এদেশে এই শিল্প অনেক বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: