আমাদের শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নয়নমণি, আমাদের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত, প্রিয়ভাজন একজন মানুষ। তিনি শুধুমাত্র দুনিয়ার সকল মুসলিমের কাছেই সম্মানিত নন, বরং আসমানের ফেরেশতাকুল, পৃথিবীর সকল প্রাণী ও আল্লাহর কাছেও অনেক বেশি প্রিয়।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা তার নামে পূর্ণ একটি
সূরা নাজিল করেছেন, যার নাম সূরা মুহাম্মদ। আজকে আমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে আলোচনা করবো।
তার পূর্ণ নাম ছিলো মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ। কুনিয়ত বা ডাকনাম ছিল আল আমিন। তাঁর পিতার নাম ছিলো আব্দুল্লাহ। দাদার নাম ছিলো আবদুল মুত্তালিব। বড় বাবার নাম ছিলো হাশেম। হাশেমের পিতার নাম ছিলো আবদে মানাফ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশ কে তার বড় দাদার নামের সাথে মিলিয়ে বনু হাশেম বা হাশেমের বংশ বলা হতো।
রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতার নাম ছিল আমেনা। নানার নাম ছিল আব্দুল ওয়াহাব এবং তাঁর পিতার নাম ছিল আবদে মানাফ।
তবে মাতা ও পিতার বংশের একই নামের দুইজন ভিন্ন ভিন্ন লোক ছিলেন। কাফির বাদশাহ আবরাহা যেই বৎসর হস্তী বাহিনী নিয়ে কাবা শরীফ ধ্বংস করতে এসেছিলো সেই বছরই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারোই রবিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। সে দিনটি ছিল সোমবার। জন্মের কয়েক মাস পর থেকেই শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুধ মাতা হালিমার গৃহে লালিত-পালিত হতে থাকেন।
পাঁচ বছর বয়সে ধাইমা তাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন। ছয় বছর বয়সে মাতা আমিনা তাকে সঙ্গে নিয়ে তার মাতুলালয় মদিনার বনু নাজ্জারে গমন করেন। সেখান থেকে ফেরার পথে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে তিনি মারা যান। আর তাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের দাসী উম্মে আয়মান মক্কা শরীফে ফিরে আসেন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতা মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই ইন্তেকাল করেন। পিতা ও মাতা মারা যাওয়ার পর তিনি দাদার তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন। আল্লাহর মহিমা বোঝা অনেক কঠিন। কিছুদিন পর তার দাদাও ইন্তেকাল করেন। এবার তার লালন-পালনের ভার তার চাচা আবু তালেব নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন।
চাচার সঙ্গে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। একবারের ঘটনা। চাচা আবু তালেব তাকে নিয়ে সিরিয়াতে ব্যবসার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পথিমধ্যে একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকের সঙ্গে তাদের দেখা হল। তার নাম ছিল বুহাইরা। বুহাইরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল এবং বললো, সাবধান এই বালকের হেফাজত করো। কারণ ইনিই হবেন শেষ নবী।
এটা শুনে আবু তালেব অত্যন্ত বিস্মিত ও চমকিত হলেন এবং আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। বুহাইরার পরামর্শে তিনি ব্যবসায়িক কাফেলা থেকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
বালক নবী কিছুদিন পর যৌবনে পদার্পণ করলেন। এবং আরবের সম্ভ্রান্ত বংশীয়া ধনাঢ্য ব্যবসায়ী নারী বিবি খাদিজার ব্যবসায়ীক কাফেলা নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে নাস্তুরা নামের একজন বিজ্ঞ সাধু ব্যক্তিও তাঁকে নবী হওয়ার সুসংবাদ দিলেন। ব্যবসায় শেষে তিনি মক্কায় ফিরে গেলেন।
তার সততা ও আমানতদারী দেখে বিবি খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। তিনি সে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন, এবং তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। সেই সময় খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার বয়স ছিল ৪০ বছর এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল ২৫ বছর।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং ৫৩ বছর বয়সে তিনি মেরাজে গমন করেন। নবুয়ত প্রাপ্তির পর তিনি সুদীর্ঘ ১৩ বছর মক্কা নগরীতে ইসলাম প্রচার করেন। এরপর কাফেরদের অত্যাচার উৎপীড়নের কারণে তিনি মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন।
মদিনা গমনের পর দ্বিতীয় বৎসর ইতিহাস প্রসিদ্ধ বদর জেহাদ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কাফের ও মুসলমানদের মধ্যে ছোট বড় অনেকগুলো যুদ্ধ হয়, তার মধ্যে পঁয়ত্রিশটি প্রসিদ্ধ ও উল্লেখযোগ্য।
রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বমোট ১১ জন স্ত্রী ছিল। এর মধ্যে দুইজন তার জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন ও বাকি ৯ জনকে রেখে তিনি জান্নাতবাসী হোন।
রাসুল সাল্লালাহ সালাম বিবিদের কে উম্মুল মুমিনীন বা বিশ্বাসীদের মা বলা হতো। এছাড়াও তার দুজন দাসী ছিলো।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিবিগণ হচ্ছেন:
- হযরত খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত জয়নব বিনতে খোজায়মা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত সাওদা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত আয়শা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত হাফসা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত উম্মে হাবিবা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত উম্মে সালমা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত জয়নব বিনতে জাহাশ রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত জুয়াইরিয়াহ রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত মায়মুনা রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত সাফিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেয়ে ছিলো চারজন। এরা সবাই খাদিজার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন:
- হযরত জয়নব রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত রুকাইয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত উম্মে কুলসুম রাযিয়াল্লাহু আনহা
- হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত্র ছিলো পাঁচ জন। এদের মধ্যে চারজন খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহু এর গর্ভে জন্ম নেন। তাঁরা হলেন:
- হযরত কাসেম রাযিয়াল্লাহু আনহু
- হযরত আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু
- হযরত তৈয়্যব রাযিয়াল্লাহু আনহু
- হযরত তাহের রাযিয়াল্লাহু আনহু
এছাড়াও দাসী মারিয়্যা কিবতীয়ার ঘরে একজন পুত্র জন্ম নেন। তার নাম ছিলো:
- হযরত ইব্রাহীম রাযিয়াল্লাহু আনহু
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সকল পুত্র শৈশব অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
এছাড়াও তার কন্যাদের পুত্র সন্তানদের মধ্যে কেবল হাসান ও হুসাইন ছাড়া বাকি সবাই শৈশবেই মারা যান।
আর এই দুজনের মাধ্যমেই রাসুল সাল্লালাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশ এখনও দুনিয়াতে বিদ্যমান আছে। আল্লাহ তায়ালা তাদের সকলের উপর দরূদ ও সালাম বর্ষিত করুন।
রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিষট্টি বছর জীবিত ছিলেন। এর মধ্যে তিনি দশ বছর মক্কায় ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন।
অতঃপর সফর মাসের দুইদিন বাকি থাকতে বুধবার তিনি অসুস্থ হোন, এবং রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে ইন্তেকাল করেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।