গ্রীষ্মকাল। অনেকের কাছেই ভীষণ গরম আর অস্বস্তিকর একটি সময়। কিন্তু আমার কাছে বসন্ত, গ্রীষ্ম আর বর্ষা এই তিনটা সময়ই ভীষণ প্রিয় ছিলো। ছিলো এ কারণে, যখন প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে। এখন প্রকৃতির কাছাকাছি নাই, তাই কখন কোন ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে, তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। তবে গ্রীষ্ম আর শীত এই দুটো ঋতু তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণেই বোঝা যায়।
এখন ঋতু পরিবর্তন জানতে হয় খবরের পাতা বা ওয়েবসাইটে আর ক্যালেন্ডারের পাতায়। অথচ, এমন একটা সময় ছিলো যখন বাসার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়েই ঋতুর পরিবর্তন বেশ বুঝতে পারতাম। তখন আমি মাত্র ষড়ঋতুর নাম শিখেছি। আর তারা কেমন হয় তা জেনেছি।
যেমন, ষড়ঋতুর বর্ণনা নামে প্রথম কি দ্বিতীয় শ্রেনীতে একটা প্রবন্ধ ছিলো, তা মোটামুটি নিচের মতো ছিলো:
গ্রীষ্মকাল: বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য। এ দুটি মাস নিয়ে হয় গ্রীষ্মকাল। এ সময়ে গনগনে রোদ থাকে। মাঠ ঘাট সব ফেটে চৌচির হয়ে যায়। কখনো ঈশান কোনে দেখা যায় কাল বৈশাখী ঝড়। গ্রীষ্মকালে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ আরও অনেক রসালো ফল পাকে। ফলের গন্ধে চারদিক ম ম করে।
গ্রীষ্মকালে আমি দেখতাম, বারান্দার মেঝে তেতে আগুন হয়ে আছে। সেখানে পা রাখাও দায়। আর বেশ ভ্যাপসা একটা গরম। তাই অপেক্ষায় থাকতাম কখন রোদ হেলে পড়ে আর ঘাম ঝড়ানো আবহাওয়া কখন দমকা হাওয়ায় রূপ নেয়। কাল বৈশাখী ঝড় কিংবা বৃষ্টি যাই হোক না কেন বৃষ্টি শুরুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সাঁ সাঁ বাতাস বয়ে যেতো। বাসার সামনে বিশাল বিল বা পুকুর থেকে ঠান্ডা বাতাস প্রায় সব সময়ই প্রবাহিত হতো।
বর্ষাকাল: বর্ষাকাল একটা সময়ই ভালো লাগতো, যখন ঘুমের সময় ঝুম ঝুম শব্দের বৃষ্টি নামতো। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভেজার খুব ইচ্ছা থাকলেও আম্মুর বকা খাওয়ার ভয়ে খুব কমই সুযোগ হতো। বর্ষাকালে বৃষ্টি হওয়ার পর পর স্নিগ্ধ বাতাসে মাটির ঘ্রাণ অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করতো। বৃষ্টি হওয়ার পর পরই প্রকৃতির স্বচ্ছ, সুন্দর রূপ ছিলো দেখার মতো। কখনো কখনো সারাদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হতো। সেই সাথে থৈ থৈ পানি। আর পানির মধ্যে বয়ে চলা ঢেড়া সাপ। সব কিছুই দেখার মতো দৃশ্য ছিলো।
শরৎকাল: চারদিকে যখন অথৈ পানি, তখন হঠাৎ করেই আকাশ জুড়ে সফেদ সাদা মেঘের ছোটাছুটি দেখা যেতো। আমি অপলক তাকিয়ে সেই মেঘ দেখতাম। আর তির তির করে বয়ে যাওয়া বাতাসে বাসার সামনের বিলে প্রতিদিনই এক ঝাঁক হাঁস ভেসে বেড়াতো। দেখার মতো একটি দৃশ্য ছিলো। নানারকম শব্দের ভীরে হাঁসদের প্যাঁক প্যাঁক কলরব শুনলে মনেই হতো না এটা কোনও যান্ত্রিক শহর। নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলে দেখা যেতো দিগন্ত জোড়া কাশফুল। আকাশের সাদা মেঘ আর নদীর ধারের কাশফুল সব যেনো মিলেমিশে একাকার।
হেমন্ত: এদেশের হেমন্তে দেখা যায় মাঠে মাঠে পাকা ধান আর কিষান কিষানীর ব্যস্ততা। সূর্য যখন পাটে বসে, তখন আকাশের হলুদাভ রং যেনো পাকা ফসলের বর্ণ ধারণ করে। শহুরে বাস্তবতায় পাকা ধান আর ক্ষেত না থাকলেও বর্ণচোরা আকাশ কিন্তু এই শহরেও ছিলো। সূর্য যখন পাটে বসতো, তখন আমি তখন আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে রং নিয়ে লুকোচুরি খেলা দেখতাম। এদেশের হেমন্ত বড় সুন্দর ঋতু।
শীতকাল: এদেশের শীতকাল বেশ আরামদায়ক। এজন্যই প্রবাদ আছে, কারো পোষমাস, কারো সর্বনাশ। নাহ। শীতকাল আমার জন্য কখনও সর্বনাশ হয়ে আসে নি। তবে শীতকালে আবহাওয়া খুব রুক্ষ আর ধুলোময়। এসময় কারও কারও অ্যালার্জি, ঠান্ডা, জ্বর ও কাশি দেখা দিতো। তবে শীতকালের সবচেয়ে মজার যে বিষয়টি ছিলো, তা হচ্ছে, ঝাঁকে ঝাঁকে বালিহাঁস উড়ে আসতো। আর তাঁরা যেখানেই এক টুকরা জলাভুমি দেখতো, সেখানেই গোসল করতে বা খাবার খেতে নামতো। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে আবার উড়ে চলে যেতো। এইসব দৃশ্য সত্যিই দেখার মতো ছিলো।
বসন্তঃ বসন্ত ঋতু আসতো আগুন রাঙ্গা কৃষ্ণচূড়া ফুলের বেশে। বাসার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটি যখন পাতা ছাড়াই ফুলে ফুলে ঢেকে যেতো তখন, আমরা বুঝতাম এখন বসন্তকাল। এ ঋতু এলে সবাই অন্যরকম চঞ্চল আর সুন্দর হয়ে উঠতো। পথে ঘাটে দেখা যেতো বুনোফুল আর দখিনা হাওয়ায় ভেসে আসতো ফুলের ঘ্রাণ। গ্রামের বাড়ীতে ঘুরতে গেলে পথে পথে ফুটে থাকা ফুলের মধু খাওয়া হতো।
আহা শৈশব! এত এত মধুর স্মৃতি ভুলি কি করে!! যুগ যুগ ধরে এদেশের শিশুদের শৈশব এমনি থাকুক।