নবী রাসুলদেরকে মানব জাতির কাছে পাঠানোর ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তায়ালা তার নিজের বানী তাদের কাছে ফেরেশতার মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন। এই বানীকে ওহী বলা হয়। যেই ফেরেশতা ইলমে ওহী পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করেছেন, তার নাম জিবরাঈল (আ)। ইলমে ওহী হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন নবী রাসুলগন। পরবর্তীতে এই বানী সমূহ লিখিত নির্দেশনা ও কিতাব আকারে সংরক্ষণ ও সংকলন করা হয়।
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, যে সাতটি বিষয়ের উপর বিশেষভাবে ঈমান আনয়ন বা বিশ্বাস করা জরুরী, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আসমানী কিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ইসলাম ধর্ম অনুসারে আল্লাহ প্রদত্ত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের সংখ্যা এবং এই গ্রন্থগুলো কোন কোন নবীর উপর নাযিল করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ।
ইসলামী ইতিহাসবিদ ও ফকীহদের মতে, আসমানী কিতাবের সংখ্যা হচ্ছে সর্বমোট ১০৪ টি। এর মধ্যে প্রধান গ্রন্থ হচ্ছে চারটি এবং বাকি ১০০ টি হচ্ছে ছোট ছোট সহীফা বা পুস্তিকা। আর এই প্রধান চারটি ধর্ম গ্রন্থ হচ্ছেঃ
- তাওরাত
- যাবুর
- ইঞ্জিল
- কুরআন
প্রথমোক্ত তিনটি ধর্মগ্রন্থ এখন আর অবিকৃত অবস্থায় নেই। কিন্তু সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ কুরআন যা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাজিল করা হয়েছে, তা এখনও অবিকৃত ও অক্ষত অবস্থায়, ঠিক যেভাবে নাযিল করা হয়েছিলো, সেভাবেই সংরক্ষিত আছে। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ হাফিজের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা এই কুরআনকে সংরক্ষন করে রেখেছেন। আর এই কিতাবের সংরক্ষনের ভার আল্লাহ তায়ালা নিজে নিয়েছেন। তাই কিয়ামতের আগ পর্যন্ত এই কিতাব সংরক্ষিত থাকবে।
যাদের উপর পবিত্র গ্রন্থগুলো অবতীর্ণ হয়েছে
হাদীসের ব্যাখ্যা ও বর্ণনা অনুযায়ী প্রধান চারটি আসমানী কিতাব যেইসব নবীদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, তাঁরা হলেনঃ
মুহাম্মাদ (সা)
১। মুহাম্মদ (সা) এর উপর নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থের নাম কুরআন। তিনি হচ্ছেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তিনি ছিলেন নিরক্ষর এবং পড়তে ও লিখতে জানতেন না। অন্যদিকে কুরআন শ্রুতিমাধুর্য ও উৎকৃষ্টতার দিক থেকে পৃথিবীর সকল গ্রন্থের তুলনায় অনন্য ও সর্বোত্তম। এটা এমন একটা কিতাব, যা পাঠক ও শ্রোতা উভয়ের অন্তরে দারুনভাবে রেখাপাত করে। শ্রুতি মাধুর্য ও বর্ণনায় অতুলনীয় যার সমকক্ষ অন্য কোনো গ্রন্থ কোনও কালে রচিত হয় নি এবং কখনো হবে না। এমনকি এই কুরআনের ভাষা আরবী না জানা লোকদের উপরও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। একমাত্র কুরআনই জান্নাতের ভাষা আরবীতে নাযিল হয়েছে। অন্যদিকে রাসুলের বর্ণিত হাদীস আর কুরআনের ভাষার মাধুর্য ও বলার ভঙ্গিমা এক নয়। যদি এটা মুহাম্মদ (সা) এর রচিত কিতাব হতো, তাহলে এর ভাষা তার বর্ণিত হাদিসের মতোই হতো। কিন্তু ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা মানুষও এই পার্থক্যটি অনায়াসে বুঝতে পারে। কুরআনের আরেকটি প্রকাশ্য মুযেযা হচ্ছে, এই কুরআন মানুষের অন্তরে হুবহু অবিকল বসে যায় ও মুখস্থ হয়ে যায়। কুরআনের মতো বড় অন্য কোনও গ্রন্থের ব্যাপারে যা কল্পনাও করা যায় না।
ঈসা (আ)
২। ঈসা (আ) এর উপর নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থের নাম ইঞ্জিল। তিনি নিজেই একজন প্রকাশ্য মুযেযা ছিলেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর বানী বা কালাম, যেমনটি আল্লাহ তায়ালা তার ব্যাপারে কুরআনে বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা চাইলে যা খুশি তা করতে পারেন এবং তিনি যে কোনও কিছু মাধ্যম ছাড়া সৃষ্টি করতে অক্ষম নন, এর প্রমাণ তিনি পৃথিবীতে ঈসা (আ) এর জন্মের মাধ্যমে রেখেছেন। ঈসা (আ) এর জন্ম আদম (আ) এর অনুরূপই ছিলো। আদম (আ) কে তিনি বাবা ও মায়ের সাহায্য ছাড়াই তৈরি করেছেন। অন্যদিকে ঈসা (আ) কে পিতার সাহায্য ছাড়াই তৈরি করেছিলেন। বস্তুতঃ আল্লাহর জন্য এই ধরনের সৃষ্টি করা কোনও কঠিন কাজ নয়। প্রত্যেক নবীরই নবুয়্যতের নিদর্শন বা চিহ্ন থাকতো। ঈসা (আ) এরও ছিলো। তিনি মৃত মানুষকে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করেছিলেন। কঠিন রোগীদের শরীরে হাত বুলালে তাঁদের রোগ ভালো হয়ে যেতো এবং অন্ধকারে তাঁর হাত উজ্জ্বল আলোর ন্যায় ঝলমল করতো। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, কাফির সম্প্রদায়ের একজন নেতা যখন তাকে শুল বা ক্রশবিদ্ধ করার জন্য ধরতে তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করলো তখন আল্লাহ তাকে ফেরেশতাদের মাধ্যমে আসমানে উঠিয়ে নিলেন। আর যে ব্যক্তি তাঁকে ধরতে গিয়েছিলো তাঁর চেহারা ঈসা (আ) এর মতো হয়ে গেলো। সে যখন অন্য লোকদের কাছে ফিরে এই খবর দিতে এলো, তখন লোকেরা তাঁকে ঈসা (আ) ভেবে ক্রশবিদ্ধ করেছিলো। ঈসা (আ) কিয়ামতের আগে আরো একবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। এবং নিজেকে খোদা দাবি করা দাজ্জালকে হত্যা করবেন। বিয়ে শাদী ও সংসার করবেন ও ৭০ বছর রাজত্ব করবেন, তারপর ইন্তেকাল করবেন। রাসুল (সা) এর কবরের ডানপাশে তাঁর জন্য জায়গা রাখা হয়েছে, যেখানে তিনি সমাহিত হবেন।
দাউদ (আ)
৩। দাউদ (আ) এর উপর নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থের নাম ছিলো যাবুর। দাউদ (আ) এর কণ্ঠস্বর অনেক সুন্দর ছিলো। তিনি যখন যাবুর কিতাব পাঠ করতেন, তখন বন্য প্রানীরাও তাঁর তিলাওয়াত শুনতে চলে আসতো। এমনকি নদীর মাছ পর্যন্ত তাঁর তিলাওয়াত শুনতে নদীর ধারে ভীর জমাতো। বনি ইসরাইলের কিছু লোকজন এটাকে একটা সুযোগ ভেবে নিলো ও তাঁরা ঐ সময়েই মাছ শিকার করতে লাগলো। মাছেরা এই ব্যাপারে আল্লাহর কাছে অভিযোগ জানালে দাউদ (আ) তাঁদেরকে শনিবার মাছ ধরতে নিষেধ করে দিলেন। বনী ইসরাইলের জন্য ইবাদতের ও পবিত্র দিন ছিলো এই শনিবার। তাই ঐদিন দাউদ (আ) নদীর ধারে বসে যাবুর তিলাওয়াত করতেন। এবার ঐসব অবাধ্য লোকেরা ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করলো। তাঁরা শুক্রবার দিন জাল পেতে রাখতো, যাতে মাছগুলো এসে আর যেতে না পারে এবং রবিবার দিন সেগুলো ধরতো। আল্লাহর নবী দাউদ (আ) এবারও তাঁদেরকে এভাবে মাছ ধরতে নিষেধ করলেন, কিন্তু তাঁরা কোনও নিষেধ মানলো না। একদিন হঠাৎ তাঁদের জনপদে সুনসান নিরবতা লক্ষ্য করা গেলো। সবাই গিয়ে দেখলো, এই অবাধ্য জনপদের বৃদ্ধরা শুকরে এবং যুবকেরা বানরে পরিনত হয়ে গেছে। তাঁরা তাঁদের আত্মীয়দের চিনতে পারতো এবং তাঁদের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করতো। তিনদিন পর তাঁরা সবাই মারা গেলো। দাউদ (আ) এর কাছে লোহা মাখনের মতো নরম ছিলো। তাই তিনি এই লোহা দিয়ে যা খুশী তাই বানাতে পারতেন। বনী ইসরাইলের মধ্যে দাউদ (আ) ছিলো প্রথম ব্যক্তি, যিনি একই সাথে নবুয়ত ও রাজত্ব পেয়েছিলেন।
মুসা (আ)
৪। মুসা (আ) এর উপর নাযিলকৃত আসমানী গ্রন্থের নাম ছিলো তাওরাত। এই কিতাব মুসা (আ) তুর পর্বত থেকে লিখিত আকারে বনী ইসরাইলের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। তাওরাত হচ্ছে এমন এক গ্রন্থ যা গ্রন্থ আকারেই মুসা (আ) এর উপর নাযিল হয়েছিলো। মুসা (আ) সঠিকভাবে কথা বলতে পারতেন না। কারণ ছোটবেলায় ফিরাউনের নিকটে মুসা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ফেরেশতারা তাঁর হাত ইয়াকুত পাথরের পরিবর্তে কয়লার উপর দিয়ে দেয়। তিনি ঐ কয়লা নিয়ে মুখে দিয়েছিলেন। এর ফলে তাঁর জিহবা পুড়ে গিয়েছিলো, যে কারণে তাঁর কথা বলতে অসুবিধা হতো। এই জন্যই আল্লাহ তায়ালা তাওরাত কিতাব তাঁর উপর গ্রন্থ আকারেই নাযিল করেছিলেন। এছাড়াও মুসা (আ) এর আরেকটি নিদর্শন ছিলো হাতের লাঠি। যা তিনি ছাড়লে বিশাল বড় সাপ হয়ে যেতো এবং ধরলেই লাঠিতে পরিনত হতো। এটা তাঁর একটি অন্যতম মুজিযা ছিলো।
এছাড়া অন্য ১০০ টি সহীফা বা ছোট পুস্তিকা অন্যান্য নবীদের উপর অবতীর্ণ হয়। এর মধ্যেঃ
- আদম (আ) এর উপর দশটি সহীফা নাযিল হয়।
- শীষ (আ) এর উপর পঞ্চাশটি সহীফা নাযিল হয়।
- ইদ্রিস (আ) এর উপর ত্রিশটি সহীফা নাযিল হয়।
- ইব্রাহিম (আ) এর উপর দশটি সহীফা নাযিল হয়।
নবীদের সংখ্যা কত
বেশীরভাগ নবী রাসুলই তাঁর পূর্ববর্তী নবী ও তাঁর ধর্মের সত্যায়নকারী ও সংস্কারক ছিলো। অবস্থার প্রেক্ষিতে শরীয়তের নির্দেশও এক রকম থাকতো না। এবং বংশ পরম্পরায় মানুষ যখন অতিরিক্ত বিপথগামী ও নতুন পরিস্থিতিতে পড়তো, তখনই আল্লাহ তায়ালা তাঁদের হিদায়াতের জন্য নতুন নবী পাঠাতেন। প্রয়োজনে তাঁদের উপর নতুন কিতাবও নাযিল করতেন। ইসলাম পূর্ব সময়ে কোনও জনপদে পাঠানো নবীর শরীয়াহ কেবল ঐ জনপদের জন্যই নির্দিষ্ট ছিলো। একমাত্র ইসলামই একমাত্র সার্বজনীন বা বৈশ্বিক ধর্ম যা পুরো বিশ্বের মানুষের হিদায়াতের জন্য নাযিল করা হয়েছে। এবং কেবলমাত্র ইসলামিক ধর্মগ্রন্থ ও হাদীসেই পূর্ববর্তী প্রসিদ্ধ নবীদের ব্যাপারে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যা অন্য কোনও ধর্মগ্রন্থে এত বিশদভাবে আলোচনা করা হয় নি। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁদের সংখ্যা কোথাও ১ লক্ষ চব্বিশ হাজার, কোথাও দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার ও কোথাও আট হাজার বলা হয়েছে। তাই আল্লাহ প্রেরিত পয়গম্বর বা নবী কত জন ছিলেন তা আল্লাহই ভালো জানেন।
এক বর্ণনা অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, পৃথিবীর বয়স প্রায় চার’শ চুয়ান্ন কোটি বছর। এবং এই সময়ে অসংখ্য জনপদ ও মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, “আমি আপনার পূর্বে অনেক রাসূল প্রেরণ করেছি, তাঁদের কারও কারও ঘটনা আপনার কাছে বিবৃত করেছি এবং কারও কারও ঘটনা আপনার কাছে বিবৃত করি নি” [সূরা গাফির (আয়াত নংঃ ৭৮ )]
এর দ্বারাই বুঝা যায়, নবী রাসুল আসলে কতজন ছিলো তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি তোমাকে সত্যধর্মসহ পাঠিয়েছি সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এমন কোনো জাতি নেই, যার মধ্যে সতর্ককারী আসেনি।’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ২৪)।
এই আয়াতের অনুরূপ অসংখ্য আয়াত কুরআনে আছে, যেখানে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জনপদের কাছে সতর্ককারী বা পথ প্রদর্শক পাঠানোর কথা বলেছেন। সে অনুযায়ী নবী রাসুলের সংখ্যা যে অসংখ্য ও অগনিত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কুরআনে কেবল প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ নবীদের কথা আলোচনা করা হয়েছে, যা আমাদের জন্য কল্যাণকর ও পথ প্রদর্শন করবে। মুসলিম হিসেবে পূর্ববর্তী সকল নবী ও তাঁদের উপর নাযিলকৃত কিতাবের উপর ঈমান আনয়ন করা ইসলামে দাখিল হওয়ার একটি অন্যতম শর্ত ও ঈমানে মুফাসসালের অংশ।
উপসংহার
মোটকথা, কুরআনে এমন নবী ও গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা আমাদের ঈমানের দাবী পূরণ করে ও আমাদের জন্য উপকারী। বাদবাকি, সবার কথা বিশদভাবে বর্ণনা করা হয় নি। কারণ পৃথিবীর শুরু থেকে সব নবীর কথা বর্ণনা করতে গেলে মানুষের ক্ষুদ্র জীবনে তা কখনোই সম্ভব নয়। আর এক কিতাবেও তা সংকলিত করা সম্ভব হতো না। তাই কুরআনে আমাদের জন্য যা উপকারী ও শিক্ষণীয় সেই সব বিষয়ই বর্ণনা করা হয়েছে। বাকিটা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।