সাধারনভাবে কোনও কিছু নিখুঁতভাবে পরিমাপ করে সুশৃঙ্খলভাবে প্রকাশ করাই গনিতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। গনিতের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। গণিত এমন এক জ্ঞান যা মানুষকে সুনির্দিষ্টভাবে পরিমাপ করে এর ফলাফল কাজে লাগাতে শিক্ষা দেয়। বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান বিষয় হচ্ছে গণিত। আর একারণেই গণিত ছাড়া বিজ্ঞানের কোনও বিষয়ই কল্পনা করা যায় না। সকল সৃষ্টির মাঝে লুকিয়ে আছে অসংখ্য গাণিতিক হিসাব নিকাশ। যারা এইসব হিসাব নিকাশ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণা করে থাকেন, তাঁদেরকে আমরা গনিতবিদ বলে থাকি। একজন গনিতবিদ বিজ্ঞান ও গনিতের বিভিন্ন বিষয় গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে থাকেন, যা মানুষকে নতুন কিছু উদ্ভাবন ও নির্ভুলভাবে ব্যবহার করতে আগ্রহী করে তোলে।
এই রচনায় আমরা গনিতের উৎপত্তি, শাখা প্রশাখা, কাজ ও এর ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানবো।
গনিতের উৎপত্তিঃ
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ বছর থেকেই মানব সভ্যতায় গণিতের প্রচলন ছিলো। ইসলামী ইতিহাস অনুযায়ী গনিতের আবিস্কার করেছিলেন আদম (আ) এর নাতি ইদ্রিস (আ)। প্রাচীন যুগে মানুষ ব্যবসা বানিজ্য এবং লেনদেনের হিসাব রাখতে হাতের পাঁচ আঙ্গুল, আঙ্গুলের কর ও মাটির দাগযুক্ত ফলক ব্যবহার করতো। ক্রমে হাতের দশ আঙ্গুল থেকেই দশমিক পদ্ধতির গণনা আবিষ্কৃত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছরে প্রাচীন ব্যবিলনীয় যুগে এসে গণিত শাস্ত্র প্রসার লাভ করে। তবে সেসময় কেবল ব্যবসায়ী ও নির্মাণশিল্পীরাই গণিত ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে গনিতের উপর ভিত্তি করে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (ব্যবিলনীয়) ও গ্রিক সভ্যতায় জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র বিকশিত হয়। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গণিত শাস্ত্র বলতে পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতিকেই বোঝানো হতো।
কিন্তু আধুনিক গণিতের সূচনা হয় প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা থেকে, পরবর্তীতে মুসলিম পণ্ডিতগণ গণিতের উপর প্রচুর গবেষণা ও অধ্যয়ন করেন। গণিতের একটি শাখা আলজেবরা মূলত এরই ফসল। এরপর মধ্যযুগে খ্রিস্টান পুরোহিতেরা গণিত শাস্ত্রের এই ফসলগুলো সংরক্ষন ও চর্চা করেন। কিন্তু সমসাময়িক সময়ে ভারতবর্ষ ও চীন-জাপানেও উচ্চ মানের গণিত চর্চা হতো। সম্ভবতঃ মুসলিম বনিকদের মাধ্যমেই এই শাস্ত্রের প্রচার ও প্রসার লাভ করে। কারণ ইসলাম ধর্মমতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যাকাতের হিসাব, ব্যবসা বানিজ্য, উত্তরোধিকার সম্পদের বন্টণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সময় অর্থ ও জমি জমার হিসাব নিকাশের জন্য গণিতের প্রয়োজন অপরিহার্য ছিলো।
গনিতের শাখা প্রশাখাঃ
আধুনিক গণিত শাস্ত্রের বিকাশের সাথে সাথে প্রচুর শাখা প্রশাখাও তৈরি হয়েছে। গনিতের উপর উচ্চশিক্ষা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচলিত আছে। শুধুমাত্র গণিতে পারদর্শী হলে বিজ্ঞানের প্রায় সকল বিষয়ই সহজে অনুধাবন করা সম্ভব। তাই গনিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের ভাষা। গণিতের বহুমুখী ব্যবহারের কারণেই এর প্রচুর শাখা প্রশাখা তৈরি হয়েছে। তবে, আধুনিক গণিত শাস্ত্রে গণিতের মূল শাখাগুলো নিন্মরূপঃ
বিশুদ্ধ গনিতঃ
১। সংখ্যা তত্ত্ব বা সংখ্যার ধারণা
২। আলজেবরা বা বীজগনিত
৩। পাটিগণিত
৪। গুচ্ছবিন্যাস তত্ত্ব
৫। জ্যামিতি
৬। স্থানিক জ্যামিতি বা টপোগনিত
৭। গাণিতিক বিশ্লেষণ
ফলিত গনিতঃ
১। ক্যালকুলাস
২। পরিসংখ্যান ও সম্ভাবনা তত্ত্ব
৩। সেট তত্ত্ব
৪। ত্রিকোণমিতি
এছাড়াও গণিতের আরো অনেক শাখা প্রশাখা আছে যেগুলো উচ্চতর গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়। এখানে শুধুমাত্র মূল শাখাগুলোই বর্ণনা করা হয়েছে।
গণিতের ব্যবহারঃ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণিতের ব্যবহার আছে। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারবো কম্পিউটার, স্মার্টফোন, আধুনিক যন্ত্রপাতি, ঘর বাড়ী তৈরি ও জায়গা জমির পরিমাপ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রেই গণিতের সুশৃঙ্খল ব্যবহার আছে। গণিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের ভাষা। তাই বিজ্ঞানের যে কোনও শাখায় অধ্যয়ন করতে হলে গণিতের জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সংখ্যার মাধ্যমে গণিত চর্চার তুলনায় গণিতের ব্যবহারিক জ্ঞান মানুষের কাছে অধিক বোধগম্য হয়ে থাকে। গণিতের বিষয়গুলো বর্ণনার মাধ্যমেও প্রকাশ করা যায়। তবে সংখ্যার মাধ্যমে গণিতের কোনও বিষয় বোঝানো হলে তাকে গাণিতিক অভিব্যক্তি বলা হয়। গনিতের দরকার হয় স্থাপত্যশিল্পে, হিসাবরক্ষক, আবিস্কারক ও গবেষণার কাজে। এছাড়াও আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের পুরোটাই গাণিতিক যুক্তির উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয় বাদ দিয়ে গণিতে দক্ষতা অর্জন সম্ভব হলেও গণিত ছাড়া বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ই গাণিতিক হিসাব নিকাশের মাধ্যমে প্রকাশ করা গেলেও গণিতের অনেক সমস্যা আজও অমিমাংসীতই রয়ে গেছে।
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিজুস, সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য।