গানিতিক সংখ্যাতত্ত্ব হচ্ছে গনিতের ভিত্তিমূলক একটি ধারণা। বিজ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে গনিত, এবং গনিতের ভিত্তি হচ্ছে সংখ্যা। গনিতে সংখ্যা বলতে সাধারণত পূর্ণ সংখ্যা বোঝানো হয়ে থাকে। সংখ্যা দুই রকম বিভাজ্য ও অবিভাজ্য। যেসব সংখ্যা পূর্ণ সংখ্যায় সমান ভাগে ভাগ করা যায়, তা হচ্ছে বিভাজ্য সংখ্যা। অন্যদিকে যেসব সংখ্যা পূর্ণ সংখ্যায় ভাগ করা যায় না, তা হচ্ছে অবিভাজ্য সংখ্যা।
সংখ্যা তত্বে সংখ্যার ভিত্তি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। সর্বাধিক প্রচলিত সংখ্যা হচ্ছে, ডেসিমাল বা দশ ভিত্তিক সংখ্যা। এছাড়াও বাইনারি বা দুই ভিত্তিক সংখ্যা এবং হেক্সাডেসিমাল বা ষোলো ভিত্তিক সংখ্যা প্রচলিত আছে।
প্রাচীন ব্যবস্থায় যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল ছিলো, তখন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের সংখ্যা পদ্ধতির প্রচলন ছিলো। এক দেশের সংখ্যা পদ্ধতি বা পরিমাপ করার প্রক্রিয়া অন্য দেশের সাথে মিলতো না। সংখ্যা ও গণনা করার পদ্ধতি ভাষার মতই আলাদা ও অনন্য ছিলো।
আন্তর্জাতিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বানিজ্য চালু হওয়ার পর দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে সময় পাটিগনিত যা সাধারন হিসাব নিকাশের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো, তা দশমিক পদ্ধতিতে প্রচলিত ছিলো। পরবর্তীতে কম্পিউটার আবিষ্কারের প্রাক্কালে বাইনারি ও হেক্সাডেসিমাল পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এছাড়াও প্রাচীন ব্যাবিলনে আট ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি ও কৃষি সমাজে ৪০ ও ১৬ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি প্রচলিত ছিলো।
দশমিক সংখ্যাঃ
সাধারণ পাটিগণিতের ভিত্তি হচ্ছে দশমিক সংখ্যা। ০ থেকে ৯ এই দশটি সংখ্যা হচ্ছে দশমিক সংখ্যার ভিত্তি। দশমিক পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার আছে বিশুদ্ধ গণিত, যেমন পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতিতে। দশমিক পদ্ধতিতে গাণিতিক হিসাব নিকাশ করতে যোগ (+), বিয়োগ (-), গুণ (*) ও ভাগ (/) ব্যবহার করা হয়।
বাইনারি সংখ্যাঃ
কম্পিউটার ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে ২ ভিত্তিক সংখ্যা। এখানে সংখ্যা প্রকাশ করতে শুধুমাত্র দুটি সংখ্যা ০ ও ১ ব্যবহার করা হয়। আমরা জানি, কম্পিউটার একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র। এবং এই যন্ত্রটি কেবল দুটি বিষয় বুঝতে পারে তা হচ্ছে, বিদ্যুৎ আছে ও বিদ্যুৎ নেই। আর তা বোঝানো হয় ১ ও ০ এই দুটি সংখ্যার মাধ্যমে। তাই বাইনারী পদ্ধতিতে ১ এর মান ১ হলেও ২ প্রকাশ করতে ১০ ব্যবহার করা হয়, এবং ৩ প্রকাশ করতে ১১ ব্যবহার করা হয়। বাইনারী পদ্ধতিতে যোগ, বিয়োগ, গুণ ভাগ দশমিক পদ্ধতির মতই তবে এখানে ১ ও ০ ছাড়া অন্য কোনও সংখ্যায় তা প্রকাশ করা হয় না।
হেক্সাডেসিমাল সংখ্যাঃ
হেক্সাডেসিমাল সংখ্যা হচ্ছে ষোল ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ০ থেকে ৯ ছাড়াও ইংরেজী প্রথম ছয়টি অক্ষর ব্যবহার করা হয়। তাই দশমিক পদ্ধতিতে ১৫ এর মান হেক্সাডেসিমাল পদ্ধতিতে ইংরেজী অক্ষর এফ (F) এর অনুরূপ। হেক্সাডেসিমাল পদ্ধতিতে যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করার পদ্ধতি দশমিকের মতোই, তবে যোগ করার পর যোগফল থেকে দশমিক হিসাব না করে ১৬ বাদ দিয়ে বাকি অংশটা লিখতে হয়। এভাবেই হেক্সাডেসিমালের যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করতে হয়।
অষ্টক বা অক্টাল সংখ্যাঃ
প্রাচীন ব্যবিলনে অক্টাল সংখ্যা পদ্ধতি প্রচলিত ছিলো। এবং বর্তমানেও কোনও কোনও গণিতের ক্ষেত্রে এর প্রচলন আছে। অষ্টক পদ্ধতিতে ০ থেকে ৭ এই কয়টি সংখ্যাকে ভিত্তিমূল ধরা হয় এবং ৭ এর পরের সংখ্যাটি হয় ১০, দশমিক হিসেবে যার মান হচ্ছে ৮। অক্টাল পদ্ধতিতে আট সংখ্যাটি নেই তাই ৭ এর পরের সংখ্যা দুই সংখ্যায় পর্যবসিত হয়। অক্টাল পদ্ধতিতে ২০ এর মান দশমিক অনুযায়ী ১৬। দশমিক সংখ্যার কাছাকাছি হওয়ায় কম্পিউটার সিস্টেমে (যেমন, লিনাক্স) অনেক সময় অক্টাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
রোমান সংখ্যাঃ
রোমান সংখ্যাপদ্ধতি সবচেয়ে বড় সংখ্যা পদ্ধতির ধারণা। এ পদ্ধতিতে ৫ কে ভিত্তি ধরে আলাদা ইংরেজী অক্ষরের মাধ্যমে এর একক প্রকাশ ঘটানো হতো। রোমান সংখ্যায় ১০০০ পর্যন্ত আলাদা একক সংখ্যা আছে। তাই এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংখ্যা পদ্ধতি। রোমান সংখ্যা পদ্ধতি এখন তেমন ব্যবহার না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দশমিকের উপর ভিত্তি করে এর ব্যবহার দেখা যায়।
বৈজ্ঞানিক অঙ্কপাতনঃ
বৈজ্ঞানিক হিসাব নিকাশের সময় অনেক বড় কোনও সংখ্যা লিখতে অঙ্কপাতন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অগানিতিক অক্ষর ও সূচক ব্যবহার করা হয়। যেমন, ক এর সূচক খ মানে হচ্ছে ক সংখ্যাটিকে খ বার গুণ করা হবে। এখন ক এর মান যদি ১০ ও খ এর মান ৩ হয় তবে ক সূচক খ সংখ্যাটির মান হচ্ছে ১০ গুণ ১০ গুণ ১০ বা ১০০০। এভাবেই অনেক বড় সংখ্যা যেগুলো স্বাভাবিক ভাবে লিখলে অনেক জায়গা খরচ ও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেগুলো সূচক আকারে লেখা হয়।
আরবীয় ও ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতিঃ
মূলত দশমিকের উপর ভিত্তি করে সংখ্যা পদ্ধতি আরবীয় ও ভারতীয় অঞ্চলে প্রচলিত ছিলো। কালক্রমে ব্যবসা বানিজ্যের বিস্তারের সময় এই পদ্ধতিটি অপরাপর সভ্যতার দ্বারা গৃহীত হয়। দশমিক সংখ্যার উপর ভিত্তি করে গণিতের বিভিন্ন হিসাব নিকাশ পরবর্তী সময়ে বিকাশ লাভ করে এবং এর উপর ভিত্তি করেই গণিত শাস্ত্রের বিভিন্ন গবেষণা ও বই লেখা হয়।
আধুনিক জীবনে সংখ্যা পদ্ধতির ব্যবহারঃ
আমাদের বাস্তব জীবনে সংখ্যা পদ্ধতির বিবিধ ব্যবহার দেখা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন জিনিসের হিসাব নিকাশে এই সংখ্যা পদ্ধতি এখনও লক্ষ্য করা যায়, যেমন ১৬ আনাতে এক ভরি, এখানে স্বর্ণ পরিমাপের একক হচ্ছে ভরি, যার ভিত্তি ১৬ এবং প্রতিটি ভিত্তিকে এক আনা হিসেবে ধরা হয়। ৪০ কেজিতে ১ মণ যা সাধারণত কৃষিপণ্য পরিমাপের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ঘড়ির কাঁটায় বা স্কুলে শ্রেনী বোঝাতে রোমান সংখ্যা ব্যবহার হয়। এছাড়াও গাণিতিক হিসাব নিকাশে দশমিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয় বাইনারী, অক্টাল, হেক্সাডেসিমাল ও ডেসিমাল পদ্ধতি। নিখুঁতভাবে পরিমাপ করার জন্য গণিত আবশ্যক। আর গণিতের ভিত্তি হচ্ছে সংখ্যাপদ্ধতি। তাই আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ব্যাপক ব্যবহার আছে।